কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে ছাত্ররা। আন্দোলনের গতির সাথে আওয়ামী লীগ সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশের প্রায় সকল বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ চলমান এবং নিহতের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। সরকারের এই বিপদের মুহূর্তে সরকারদলীয় সংগঠন, ব্যক্তি এমনকি দূতাবাসের আওয়ামী সমর্থক-কর্মকর্তাদের অজস্র ভুয়া খবর শেয়ার করতে দেখা যাচ্ছে, যা ইতিমধ্যে যাচাইও হয়েছে বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকারদের মাধ্যমে। ফেসবুক টুইটারে ছড়াচ্ছে সরকার দলের এসব মিথ্যা গুজব।
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত গুজবের সবচেয়ে বড়টি বোধ হয় আইনজীবী মানজুর আল মতিনকে নিয়ে। গত ৩০ জুলাই, কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কারীর মুক্তি ও শিক্ষার্থীদের দিকে গুলি ছোড়া বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজুর আল মতিন হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। মানজুরের সে বক্তব্য দেশজুড়ে বেশ আলোচিত হওয়ার পর থেকেই এই আইনজীবীর বিরুদ্ধে কখনো ছাত্র শিবিরের সঙ্গে কথিত অতীত সম্পৃক্ততা এবং তার পরিবারের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের আত্মীয়তার দাবিগুলো ছড়ানো শুরু করে আওয়ামী সমর্থকরা।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ, সাপোর্টার্স অব আওয়ামী লীগ, বর্তমান সংসদের এমপি নাহিম রাজ্জাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ছাত্রলীগ নেতা ‘পাকিস্তানি দালাল রুখবে তারুণ্য’ নামের একটি সংগঠনের আহ্বায়ক হামরা রহমান অন্তর, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ‘শেখ হাসিনা—ডটার অব ডেমোক্রেসি’ বইয়ের লেখক আবুল হাসনাত মিল্টনসহ আওয়ামী লীগের পদস্থ নেতাদের অনেকে মানজুর আল মতিনের সাথে জামায়াত নেতা নিজামী এবং গোলাম আযমের পরিবারের আত্মীয়তার ভুয়া খবর প্রচার করেন। পরবর্তীতে ডিসমিসল্যাব নামে বাংলাদেশের একটি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান মানজুরের মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নিজামী পরিবারের সাথে কথা বলে সেই দাবির ভিত্তিহীনতা নিশ্চিত করে।
একইভাবে আরেকটি ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তান দূতাবাসের বরাতে। ফেসবুকে বাংলাদেশস্থ পাকিস্তানের দূতাবাসের সিলযুক্ত একটি বিবৃতিতে বলা হয়, ছাত্রদের এই সর্বাত্মক আন্দোলনে পাকিস্তানের দূতাবাসের সাহায্য-সমর্থন আছে।
পরে দেখা যায়, খোদ পাকিস্তানের দূতাবাস তাদের অফিসিয়াল টুইটার এবং ফেসবুক পেজ থেকে নিশ্চিত করে, তারা এমন কোনো বিবৃতি দেয়নি। কিন্তু ততক্ষণে আওয়ামী লীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র তাহসিন বাহার সূচনা, ছাত্রলীগনেতা তানভীর হাসান সৈকত, অমি রহমান পিয়ালসহ অনেককে এটি শেয়ার করতে দেখা গেছে।
রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে পিছিয়ে নেই কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আরিফা রহমান রূমা যিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং বর্তমানে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর তিনি। তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দুটি ছবি দিয়ে দাবি করছেন, জামায়াত শিবিরের কর্মীরা নারীদের বোরকা পরে মিছিলে অংশ নিচ্ছে। কিন্তু পরে দেখা যায়, অন্তত পাঁচ বছরের পুরনো ভিন্ন ঘটনার ছবিকে বর্তমানের বলে দাবি করছেন তিনি। একই পোস্ট পাওয়া যায় সাপোর্টার্স অব আওয়ামী লীগ গ্রুপসহ অজস্র ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মী পরিচয় দেওয়া আইডি থেকেও।
গুজব থেকে বাদ যায়নি চলমান ছাত্র আন্দোলনের নিহতরা। আন্দোলন শুরুর দিকে জুলাই মাসে নিহত হয় ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ও কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজ। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কালবেলা পত্রিকার বরাতে ছড়ানো হয়, তার গৃহশিক্ষক শিবিরের নেতা আবির হোসাইন কৌশলে ফারহান ফাইয়াজকে হত্যা করে। পরবর্তীতে কালবেলার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে, দৈনিক কালবেলা এমন কোনো খবর প্রকাশ করেনি। কিন্তু যাচাই না করে সেটি পোস্ট করেন আরিফা জেসমিন কনিকা যিনি মূলত ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের স্ত্রী এবং আওয়ামী মহিলা লীগ নেত্রী।
অপরদিকে প্রতিমন্ত্রী পলককে দেখা যায়, সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া খবর প্রচারের জন্যে বিরোধী রাজনৈতিক দল এমনকি সামাজিক মাধ্যমগুলোকে দায়ী করতে। এছাড়া একই পোষ্ট করতে দেখা যায় নাহিদ রেইন্স (নাহিদ এম হেলাল) নামের আওয়ামী লীগ সমর্থিত তথ্যপ্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এম আরাফাতের ঘনিষ্ঠ এক এক্টিভিস্টকে।
মূলত সরকার তার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ছে এবং এর সাথে সাথে তাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এসবের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অজস্র ভুয়া খবর প্রচার করে তারা আন্দোলনকারীদের বিভ্রান্ত করার প্রশ্নবিদ্ধ কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
সোর্সঃ বাংলা আউটলুক