লোহিত সরণ বা রেড শিফট কী?
তখন না ছিল এই পৃথিবী, না ছিল চাঁদ। এমনকি এই বিশাল মহাবিশ্বেরও কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এমনকি স্থান-কাল নামের কিচ্ছু ছিল না। তখন সময়েরও কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ছিল শুধু একটা অসীম ভরের অসীম ঘনত্বের একটা বিন্দু। হঠাৎ করেই যেন সেই বিন্দুর কিছু একটা হলো।

তখন না ছিল এই পৃথিবী, না ছিল চাঁদ। এমনকি এই বিশাল মহাবিশ্বেরও কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এমনকি স্থান-কাল নামের কিচ্ছু ছিল না। তখন সময়েরও কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ছিল শুধু একটা অসীম ভরের অসীম ঘনত্বের একটা বিন্দু। হঠাৎ করেই যেন সেই বিন্দুর কিছু একটা হলো।
কোনো এক অজানা কারণে সেই অদ্ভুতুড়ে বিন্দুটা ছোট্ট থেকে বড়ো হতে থাকল। আর্বিভাব হলো স্থান-কাল নামক এক অদ্ভুত চাদরের। বিন্দুটার ভিতরে থাকা সেই স্থান-কালের চাদর, অণু-পরমাণু, শক্তি সব ছড়িয়ে পড়ল অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। ছড়াচ্ছে তো ছড়াচ্ছেই। বড়ো হচ্ছে তো হচ্ছেই। এর থেকেই আস্তে আস্তে একে একে তৈরি হলো মৌল, যৌগ, তারা, গ্রহ, নীহারিকা, ছায়াপথ আরও কত কী! তৈরি হলো এই বিশাল মহাবিশ্ব। এই ঘটনাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে বিগ ব্যাং। আর এই মহাবিশ্বেরই কোনো একটা ছায়াপথের কোনো একটা সৌরজগতের কোনো একটা হলুদ নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা কোনো এক গ্রহের কোন এক স্থানে বসে এই প্রবন্ধটি পড়ছেন আপনি।
অসাধারণ, তাই না? সবচেয়ে অদ্ভুত কী জানেন? ওই যে বললাম মহাবিশ্বের ছড়ানোর কথা। তা এখনও প্রসারিত হচ্ছে। এমনকি ভবিষ্যতেও তা হতে থাকবে। কিন্তু তা দেখার জন্য তখন হয়তো এই মানবসভ্যতার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।

কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? না হওয়ারই কথা, এমনকি বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনেরও তা বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু তাঁর আইনস্টাইন ক্ষেত্র সমীকরণ (Einstein field equations) -এর এক ফলাফল তাঁর বিশ্বাসের পুরো বারোটা বাজিয়ে দেয়। নিজের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তাই তো তিনি সূত্রে এই প্রসারণ থামানোর জন্য বসিয়ে দিলেন একটা ধ্রুবক। সবাই তো তাঁর অগাধ ভক্ত। তাই কেউ আর প্রশ্ন করেননি।
এরপর এলেন সেই বিখ্যাত ব্যক্তি, যাঁর নাম আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান (Alexander Friedmann)। রাশিয়ার এই তিনিই প্রথম বলেন মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল যা সব দিক থেকে সমানভাবে অগ্রসর হয়। তখন তেমন কেউ আমলে নেয়নি। কিন্তু পরে এডউইন হাবল নামক এক জ্যোর্তিবিদ আসেন। প্রমাণ করেন তাঁর মতবাদকে। তিনি টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে প্রমাণ করে দিলেন মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতাকে। ভেঙে দিলেন আইনস্টাইনের বিশ্বাস। চারদিকে তাঁর জয়জয়কার।
তিনি কোনো এক গভীর রাতে ধন্যবাদ জানালেন সেই রেড শিফটকে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতাকে প্রমাণ করতে সাহায্য করার জন্য।
জানতে ইচ্ছা করে কী এই রেড শিফট যা তাঁকে এই বিশাল জিনিস প্রমাণ করতে সাহায্য করে। তো চলো জেনে নিই কী এই রেড শিফট। তার আগে জানতে হবে ডপলার ইফেক্টে (Doppler effect) -র কথা।
ডপলার ইফেক্ট
একটা সহজ উদাহরণ দেখি। ধরলাম, একটা প্লেন নীল আকাশে উড়ছে। আপনি একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখছেন যে প্লেনটা আপনার দিকে আসছে। প্রথমে আপনি শুনতে পাবেন প্লেনের একটি তীক্ষ্ণ শব্দ। যা ক্রমশ তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হতে থাকবে। আর যখন প্লেনটা আপনাকে অতিক্রম করে অনেক দূর চলে যাবে তখন কোনো শব্দই শুনতে পাবেন না। মনে হবে যেন তা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকবে।
যদি প্লেনের উদাহরণটা বোধগম্য না হয় তবে আরো একটি সহজ উদাহরণ দেয়া যাক। আপনার দিকে আসতে থাকা একটা অ্যাম্বুলেন্স আর তার সাইরেনের কথা চিন্তা করতে পারেন।

উভয় উদাহরণের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে আমাদের দিকে ধেয়ে আসা কোনো উৎস থেকে কোনো শব্দ এলে তা প্রথমে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হতে থাকে। এরপর তা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় এবং একসময় আর কোনো শব্দ শোনা যায় না। এই ঘটনাকেই বলে ডপলার ইফেক্ট।

মোদ্দাকথা হলো যদি কোনো স্থির উৎস থেকে শব্দ আসে তবে তবে তা চারদিকে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু যদি উৎসটা চলমান হয় তবে সেই উৎসটা যেই দিকে ধাবমান শব্দ সেই দিকেই যায় এবং সে দিকে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য (Wavelength) কমে এবং তার কম্পাঙ্ক (Frequency) বাড়ে। আর এর বিপরীত দিকে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়ে এবং কম্পাঙ্ক কমে। মোটকথা, কোনো শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কমে, অর্থাৎ কম্পাঙ্ক যত বাড়ে, শব্দটা তত তীক্ষ্ণ হতে থাকে। আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বাড়ে, অর্থাৎ কম্পাঙ্ক যত কমে, শব্দটা তত ভোঁতা হতে থাকে। আর এটা আলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেননা আলোও এক প্রকার তরঙ্গ। আর তরঙ্গের বেলাতেই শুধু ডপলার ইফেক্ট কাজ করে। উল্লেখ্য, আলোক তরঙ্গ হল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং শব্দ তরঙ্গ হল যান্ত্রিক তরঙ্গ।
ডপলার ইফেক্ট নিয়ে মোটামুটি প্রাথমিক আলোচনা হয়ে গেল। এবার আসি মূল কথায়।
আবার ধরলাম। না, এবার প্লেন বা অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি না, সোজা ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি। ধরলাম, আমাদের গ্যালাক্সিসহ সব গ্যালাক্সি, এমনকি এই পুরো মহাবিশ্বটা যদি স্থির থাকত তবে তাদের যে-কোনো একটা গ্যালাক্সি থেকে আসা আলো চারদিকে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ত।
রেড শিফট
আবার যদি একটা গ্যালাক্সি আমাদের গ্যালাক্সির দিকে বা পৃথিবী থেকে দূরে সরে যায় তবে তার থেকে আসা বিকিরিত আলো ডপলার ইফেক্ট অনুযায়ী পৃথিবীর দিকে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকবে বেশি এবং গ্যালাক্সির চলার পথের উলটো পাশে থাকবে কম। যার ফলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়তে থাকায় সেখান থেকে আসা আলোর বর্ণালী লালের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে।

যেহেতু লাল আলোর ক্ষেত্রে তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি এবং কম্পাঙ্ক সবচেয়ে কম, তাই তখন আসা আলো দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীর লাল প্রান্তের দিকে ‘স্থানান্তর’ ঘটাবে, যাকে জ্যোর্তিবিজ্ঞানের ভাষায় বলে রেড শিফট। রেফ শিফট মানে এই নয় যে বস্তুটিকে লাল দেখাবে।
ব্লু শিফট
আবার যদি একটা গ্যালাক্সি পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে তবে তা ডপলার ইফেক্ট অনুযায়ী তার থেকে আসা বিকিরিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পৃথিবীর দিকে থাকবে কম এবং গ্যালাক্সির চলার পথের উলটো পাশে থাকবে বেশি। কেননা তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কমতে থাকবে উৎসটা থেকে আসা আলো দৃশ্যমান আলোর বর্ণালী তত বেগুনি রঙের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে যেহেতু বেগুনি আলোর ক্ষেত্রে তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম এবং কম্পাঙ্ক সবচেয়ে বেশি। আর একে বলে নেগেটিভ রেড শিফট বা ব্লু শিফট বা ভায়োলেট শিফট।

মোটামুটি এই ধারণা নিয়েই মাঠে নামেন বিজ্ঞানী হাবল। আর যখন তিনি দেখলেন অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেগুনির দিকে সরে যাচ্ছে, অর্থাৎ ব্লু শিফট দেখাচ্ছে; আবার মহাবিশ্বের বেশিরভাগ বস্তু থেকে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য লালের দিকে সরে যাচ্ছে, অর্থাৎ রেড শিফট দেখাচ্ছে তখন তিনি এক প্রকার খেই হারিয়ে ফেললেন।
পরে আরও পর্যবেক্ষণের পর নিশ্চিত হলেন যে মহাবিশ্বের বেশিরভাগ বস্তুই রেড শিফট দেখাচ্ছে। আবার আইনস্টাইনের পরিবর্তিত ফিল্ড ইকুয়েশনও একই ফলাফল দেয়। ফলে শেষমেশ একটা ফলাফল আসে যে, মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল। এমনকি প্রতি মুহূর্তে তা আগের তুলনায় আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। যেন এক বিস্তার লাভকারী অদম্য বোমা প্রতি মুহূর্তে রেড শিফটের মাধ্যমে নিজের কর্মকাণ্ডকে জাহির করছে। আর এই রেড শিফটের মাধ্যমেই ‘মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল’ এর প্রাথমিক প্রমাণ মেলে।
তথ্যসূত্র: